মো. মোশারফ হোসাইন, নিজস্ব প্রতিবেদক:
বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে পাঠ্য বইয়ের বাইরে পাঠাভ্যাস ব্যাপকভাবে কমে গেছে। আগে ব্যক্তি উদ্যোগে গ্রাম-গঞ্জে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হতো, এখন আর তেমনটি চোখে পড়েনা। তাই স্বাভাবিক কারনেই বিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্যক্রমের বাইরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার উদ্যোগও লক্ষ করার মতো নয়। এ দেশে ভালো লাইব্রেরি-ব্যবস্থা আজ প্রায় নেই বললেই চলে। আগে ব্যক্তি উদ্যোগে গ্রাম-গঞ্জে গড়ে ওঠা লাইব্রেরি গুলো হয়তোবা পাঠকের অভাবে সংখ্যায় দিন দিন কমে আসছে। এদের ব্যবস্থাপনা দুর্বল, বইয়ের মান নিয়েও পাঠকের মনে রয়েছে নানান প্রশ্ন, আর ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত গ্রাম-গঞ্জের লাইব্রেরির পরিবেশ নিয়ে কথা বলাটা যেন একপ্রকার বোকামী। ভালো বই বাড়িতে নিয়ে পড়ার সুযোগ পাঠকদের আজ নেই বললেই চলে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে জাতির মননশীলতা ও জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি আস্তে আস্তে নাজুক হয়ে পড়ছে।
এমতাবস্থায় আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র জনগণের মধ্যে পাঠাভ্যাস বাড়াতে বহু বছর ধরে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি পরিচালনা করে আসছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পক্ষ থেকে দেশের প্রতিটি বাড়ির দোরগোড়ায় বই পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে দেশভিত্তিক উৎকর্ষ কার্যক্রম ও পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কার্যক্রমের পাশাপাশি সারা দেশে গড়ে তোলা হয়েছে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। বর্তমানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরি বা ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিই সকলের একমাত্র ভরসায় পরিণত হয়েছে। দিন দিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির চাহিদা বাড়ছে, অস্বাভাকি হারে বাড়ছে এ লাইব্রেরির সংখ্যা ও পাঠক তথা সদস্য সংখ্যা।
জানা গেছে, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির দৃষ্টিনন্দন গাড়িগুলো ৭টি আলাদা আকারের করে তৈরী করা হয়েছ। এগুলোতে যথাক্রমে ৪ হাজার, ৬ হাজার, ৮ হাজার, ১১ হাজার ও ১৭ হাজার করে বিভিন্ন লেখকের ভালো মানের বই রয়েছে। ভ্রাম্যমাণ প্রতিটি লাইব্রেরি প্রতি সপ্তাহে গ্রাম-গঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে ৩০ মিনিট থেকে ২ঘণ্টা পর্যন্ত সদস্যদের মধ্যে বই লেনদেন করে। সপ্তাহের কোন দিন, কখন কোন গাড়ি কোন এলাকায় কোথায় যাবে, তা আগে থেকেই ঠিক করেদেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির কর্তৃপক্ষ।
তথ্য মতে, ১৯৯৯ সালে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি প্রথমে চালু হয় দেশের ৪ টি বড় শহরে তথা ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী নগরিতে। এরপর এর পরিধি বৃদ্ধি করে ২০১৪ সালে দেশের ৫৮টি জেলার মোট ২৫০টি উপজেলার প্রায় একহাজার ৯০০ লোকালয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়; তখন দেশের অন্তত একহাজার ৯০০টি ছোট লাইব্রেরির কাজ করে বলে মনে করা হতো। ২০১৪ সালে এসকল লাইব্রেরিতে শিক্ষার্থী সদস্য সংখ্যা ছিলো প্রায় ৩ লক্ষ ৩০ হাজার।
বর্তমানে সারাদেশে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনায় সারাদেশে ৭৬টি ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি চলমান রয়েছে। তবে ২০১৯ সালের আগে সারাদেশে তাদের ৪৬টি ভ্রাম্যমান লাইব্রেরি ছিলো। তাই বাধ্য হয়ে জামালপুর জেলার জন্য বরাদ্দকৃত লাইব্রেরির মাধ্যমে জ্ঞানের আলো ছড়ানোর লক্ষে সপ্তাহে ২দিন শেরপুর জেলায় এসে বই লেনদেন করতে হতো। ২০১৯ সালে সারাদেশের জন্য নতুন আরও ৩০ টি ভ্রাম্যমান লাইব্রেরি সংযোজন করা হয়। এতে শেরপুর জেলার জন্য একটি লাইব্রেরি বরাদ্দ করে সংশ্লিষ্ঠ কর্তৃপক্ষ। ওই বছরের ১০ জুলাই তারিখে শেরপুর জেলার জন্য বরাদ্দকৃত লাইব্রেরিটি শেরপুর ইউনিট এলাকায় পৌঁছে। পরে ২০১৯ সালের ৫ আগষ্ট তারিখে শেরপুর জেলার মান্যবর জেলা প্রশাসক আনার কলি মাহবুব আনুষ্ঠানিক ভাবে এ ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিটি উদ্বোধন করেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমান লাইব্রেরি কার্যক্রমের আওতায় শেরপুর ইউনিটের ভ্রাম্যমান এ লাইব্রেরিটি প্রতি সপ্তাহে ৬ দিন (মঙ্গলবার ব্যাতিত) শেরপুর সদর উপজেলা, নকলা উপজেলা, নালিতাবাড়ি উপজেলা ও শ্রীবরদী উপজেলায় ভ্রাম্যমান লাইব্রেরির কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এ কার্যক্রমে শেরপুর ইউনিটের দায়িত্বে আছেন লাইব্রেরি কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল আলম।
লাইব্রেরি কর্মকর্তা তৌহিদুল আলম জানান, শেরপুর ইউনিটের আওতায় ৪টি উপজেলায় ৪৪ টি স্পটে বা এলাকায় এ কার্যক্রম সুন্দর ভাবে চলছে। এসকল স্পটে ৫৩৮ জন শিক্ষার্থী এরই মধ্যে সদস্য হয়ে নির্ধারিত স্পটে গিয়ে বই লেনদেন করছে। স্পট গুলোর মধ্যে শেরপুর সদর উপজেলার ১১টি স্পটে শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত, ৭টি স্পটে সোমবার সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩ টা পর্যন্ত ও ৬টি স্পটে বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বই লেনদেন করা হয়। তাছাড়া জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার ৭টি স্পটে শনিবার সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত, নকলা উপজেলার ৬টি স্পটে রবিবার সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ও শ্রীবরদী উপজেলার ৭টি স্পটে বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত পূর্ব নির্ধারিত স্থানে বা স্পটে সদস্যদের মাঝে বই লেনদেন করা হয়। করোনা ভাইরাস (কোভিট-১৯)-এর প্রভাব না পড়লে সদস্য ও স্পট সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি হতো বলে লাইব্রেরি কর্মকর্তা তৌহিদুল আলম জানান।
ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির কার্যক্রমের বার্তা সকলের মাঝে পৌঁছে দিতে মুদ্রিত হ্যন্ডবিলের মাধ্যমে জানা গেছে, বাৎসরিক বা ষান্মাসিক ভিত্তিতে বই রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসিক ১০ টাকা হারে ফি জমা দিয়ে সদস্য হতে হয়। তাছাড়া অনধিক ২৫০ টাকা মূল্যের একটি বই বাড়িতে নিয়ে পড়ার আগ্রহী বিশেষ সদস্যদের জন্য ফেরতযোগ্য (নিরাপত্তা অর্থ বাবদ) ২০০ টাকা ও অনধিক ২০০ টাকা মূল্যের একটি বই বাড়িতে নিয়ে পড়ার আগ্রহী সাধারণ সদস্যদের জন্য ১০০ টাকা নিরাপত্তা অর্থ বাবদ ফেরতযোগ্য জমা দিয়ে পছন্দ অনুযায়ী সদস্য হতে হয়।
এবিষয়ে নকলা শহরের গ্রীণরোডস্থ প্রয়াস টিউটোরিয়াল হোমের পরিচালক মেহেদী হাসান হিমেল বলেন, দেশের প্রতিটি এলাকা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই লাইব্রেরির স্পট দেওয়া হলে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠবে।
গনপদ্দী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, সব শিক্ষার্থীরাই পাঠ্য বইয়ের পড়ালেখা করে। কিন্তু অনেকেই পরীক্ষার ফলাফলে অল্প পয়েন্ট নিয়েও ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়, এমনকি ভালো পদে চাকরির সুযোগ করে নেয়। এর পিছনের কারন হলো- ছাত্র জীবনে পাঠ্য বইয়ের বাহিরের অর্জিত জ্ঞান। আর যে বা যারা ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির মতো বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নিয়ে বাহিরের জ্ঞান অর্জন করেছে, তারাই সফলতা পেয়ে আসছে। তাই তথ্য-প্রযুক্তি ও সৃজনশীলতার এ যুগে পুথিগত বিদ্যার বাহিরে জ্ঞান অর্জন করতে হলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কর্তৃক পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির বিকল্প নেই বলে তিনি মনে করেন।
আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পক্ষ থেকে দেশের প্রতিটি বাড়ির দোরগোড়ায় বই পৌঁছে দেওয়ার লক্ষে দেশভিত্তিক উৎকর্ষ কার্যক্রম ও পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কার্যক্রমের পাশাপাশি সারা দেশে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি চালু করা হয়েছে। এ সুবাধে গ্রাম-গঞ্জের শিক্ষার্থীরা অনেক স্বনামধন্য লেখেকের বই হাতের নাগালে পেয়ে আজ তারা আদর্শ মানুষ রূপে পরিণত হচ্ছেন বলে শিক্ষানুরাগীরা মনে করছেন।